সংগৃহীত
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার কৃষি পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। শুধু অগ্রাধিকারই নয়, নগদ ও উপকরণ সহায়তা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর কৃষি খাতকে গতিশীল করার জন্য এরই মধ্যে রাজস্ব বাজেট থেকে প্রায় ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এই বরাদ্দের আওতায় কৃষকদের ধাপে ধাপে নগদ অর্থ ও বিনামূল্যে সার-বীজের মতো কৃষি উপকরণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। যাতে বন্যায় ভেঙে যাওয়া কৃষকের মনোবল দ্রুত ফিরে আসে এবং আবার মাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তাই নিশ্চিত হবে না, দ্রুত কৃষি খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ১৪ লাখেরও বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব কৃষকের দুই লাখ ৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এতে ফসলের ক্ষতি হয়েছে ৭ লাখ ১৪ হাজার টনেরও বেশি। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ তিন হাজার ৩৪৫ কোটি। ভয়াবহ এই বন্যার পর, কৃষি পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে নতুন করে আমন চাষে।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কৃষি পুনর্বাসন। যে কারণে ফসল নষ্ট হওয়া জমিগুলো দ্রুত চাষের আওতায় আনতে কাজ শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই। এই কার্যক্রমের আওতায় ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার আশপাশে দ্রুত আমনের বীজতলা তৈরি করা হয়েছে, যা দিয়ে পুনরায় আমনের আবাদ করা হবে। এ ছাড়া শাক-সবজিসহ অন্যান্য জমিতেও চাষাবাদ ফিরিয়ে আনতে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য কাজ চলছে।
সব মিলিয়ে, অন্তর্বর্তী সরকার এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি নিয়ে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই কর্মসূচির মধ্যে তাৎক্ষণিক সহায়তা যেমন রয়েছে, তেমনি আসন্ন রবি মৌসুমের জন্যও রয়েছে নানা ধরনের সহায়তা।
তাৎক্ষণিক কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ বিনামূল্যে ধানের বীজ, সার ও নগদ এক হাজার করে টাকা প্রদান। এই কর্মসূচিতে কৃষি উপকরণ হিসেবে প্রত্যেক কৃষককে বিনামূল্যে পাঁচ কেজি করে স্বল্পমেয়াদি ব্রি-৭৫, বিনা-১৭ জাতের বীজধান, ১০ কেজি করে ডিএপি ও এমওপি সার দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া দেওয়া হচ্ছে নগদ এক হাজার করে টাকা। এই কর্মসূচিতে মোট ৮০ হাজার কৃষককে (প্রত্যেককে ১ বিঘা জমি) বীজ ফসল, বীজ ধান অথবা বীজ দেওয়া হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বীজ ধান দেওয়া হয়ে গেছে। সঙ্গে দুই রকমের সার ও এক হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এই কর্মসূচিতে মোট ৯টি জেলার ৮০ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বিনামূল্যে রোপা আমনের বীজ ও সারসহ ১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা নগদ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
পরবর্তী ধাপে ২২ জেলার দেড় লাখ কৃষককে আগাম রবিশস্য করার জন্য বীজ ও নগদ এক হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। তাদের প্রত্যেককে ৫ শতাংশ জমিতে আগাম শীতকালীন সবজি চাষের জন্য এই সহায়তা প্রদান করা হবে।
এর পর পরই বোরো আবাদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি প্রান্তিক কৃষককে ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি সার ও এক হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এগুলো রাজস্ব খাত থেকে দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য ২২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। এর বাইরে প্রণোদনা খাত থেকেও দেওয়া হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বন্যায় এবার কম-বেশি দেশের ২৭ জেলা বন্যার কবলে পড়েছে। এর মধ্যে ২৩টি জেলার ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় মোট তিন লাখ ৭২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ফসলি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে ধানসহ অন্যান্য ফসল রয়েছে।
মোট ফসল উৎপাদনে ক্ষতি ৯ লাখ ৮৬ হাজার ২১৪ টন। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৮৯ জন। ফসল ছাড়াও জানমালের পাশাপাশি বড় ক্ষতি হয়েছে মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ খাতের, যা টাকার অঙ্কে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটিরও বেশি।
ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের মধ্যে আউশ ধান ছিল ৩৮ হাজার ৬৮৯ হেক্টর, রোপা আমন আবাদ ১ লাখ ৪১ হাজার ৬০৯ হেক্টর, বোনা আমন ৭৬৪ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা ১৪ হাজার ৯০৮ হেক্টর এবং ১১ হাজার ২৯০ হেক্টর সবজি জমি। এ ছাড়া আদা, হলুদ, ফলবাগান, মরিচ, পান, তরমুজ, পেঁপে, টমেটোসহ আরও কিছু ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন ফসলের ৯ লাখ ৮৬ হাজার ২১৪ টন উৎপাদন একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির মধ্যে রয়েছে ৩৮ হাজার ৬৮৯ হেক্টর আউশ, এক লাখ ৪১ হাজার ৬০৯ হেক্টর রোপা আমন, ৭৬৪ হেক্টর বোনা আমন, ১৪ হাজার ৯০৮ হেক্টর রোপা আমন বীজতলা
আক্রান্ত ২৩ জেলায় বিভিন্ন ফসল চাষ করা হয়েছিল ১৪ লাখ ৩০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে। গড়ে এ ফসলের ১৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। ক্ষতির এ তালিকায় আমন-আউশ ধানের পরই রয়েছে শাক-সবজি। ১ লাখ ৭৬ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি নষ্ট হয়েছে, যার মূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
এবারের ভয়াবহ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চট্টগাম এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। ফলে এসব জেলার কৃষকও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কক্সবাজার এবং রাঙ্গামাটি জেলার ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এসব জেলার খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
তাই বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারও কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সংখ্যা ও ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণ করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও অবকাঠামো মেরামত সময় সাপেক্ষ হলেও, সরকার চাইছে দ্রুত পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদের আবার কৃষি কাজে ফিরিয়ে আনতে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, বন্যার ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের পুনর্বাসন কর্মসূচির পরিকল্পা প্রণয়ন করা হয়েছে। আসন্ন রবি মৌসুমে কৃষক যাতে সবজি এবং বোরো আবাদ করে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে সে জন্য আর্থিক ও কৃষি উপকরণ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো জেলায় এই পুনর্বাসন কর্মসূচি শুরু হয়ে গেছে বলে মাঠ পর্যায় থেকে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শুরু থেকে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দুর্গত এলাকায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী মাঠে রয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে সব রকমের সহায়তা দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয় অধিক ক্ষতিগ্রস্ত জেলায় ৮০ হাজার কৃষককে প্রণোদনা দিয়েছে। যার মধ্যে ধানবীজ, সার ও নগদ অর্থ সহায়তা অন্তর্ভুক্ত। এ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে কৃষকদের জন্য ১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’
কৃষি সচিব বলেন, আমরা মনে করছি, দু’-চারটি জেলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে, তা আমরা পুষিয়ে উঠতে পারব। এ ছাড়া আগামী বোরো ফসলকে যদি সফল করতে পারি, তা হলে আমার মনে হয় এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারব। এ জন্য আসন্ন রবি ফসলের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হবে।
জানা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত সব কৃষককেই প্রণোদনার আওতায় আনার চেষ্টা করবে কৃষি মন্ত্রণালয়। যাতে করে যার যার জমির উপযোগী ফসল উৎপাদনে ভাটা না পড়ে। বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ধানের বীজ, চারা, সার ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বন্যার পানি পুরোপুরি চলে যাওয়ার পর ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে সেই অনুযায়ী কর্মসূচি নিয়ে আগাবে মন্ত্রণালয়।
এর আগে গত ২৪ আগস্ট, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সব বিভাগের সঙ্গে একটি সভা করেন। সেখানে কৃষি পুনর্বাসনের জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেখানে আরও বলা হয়, বন্যাদুর্গত এলাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমন ধানের উৎপাদন নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। যেখানে আমন উৎপাদন সম্ভব নয়, সেখানে শাক-সবজিসহ উপযোগী অন্যান্য ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে।
দ্রুততম সময়ে আমনের বীজতলা তৈরি, বন্যাকবলিত এলাকার নিকটতম এলাকায় বীজতলা প্রস্তুত করা, মাঠ পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা ও উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণকে বন্যাউত্তর কৃষি পুনর্বাসনের কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে শুরু করা, বন্যাকবলিত এলাকায় ব্লক এবং উপজেলাভিত্তিক পুনর্বাসন পরিকল্পনা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন উপদেষ্টা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মতে, সাম্প্রতিক বন্যায় ৫০ লাখেরও বেশি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং পানিতে আটকা পড়ে প্রায় ৯ লাখ পরিবার। শুধু ফেনীতেই ২৯ জন নিহত হওয়ার খবরসহ ১১টি জেলায় মোট ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও স্পষ্ট হচ্ছে।
ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের পরিচালক ও ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজের সাবেক উপাচার্য ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বন্যার পর কৃষির পুনর্বাসনই আমাদের বড় অগ্রাধিকার। বন্যার পানি সরে গেলে জমিতে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ শুরু করেন গ্রামের কৃষক। কারণ তার খাদ্য নিরাপত্তা দরকার। তাতে তারা বিনিয়োগ করেন বেশি। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ সময় সরকারি সহায়তা পেলে চাষাবাদে উৎসাহ বেড়ে যায় কৃষকের। অধিক উৎপাদন থেকে বাজারজাত উদ্বৃত্ত বেশি হয়। পণ্যমূল্য হ্রাস পায়। তাতে লাভবান হন ভোক্তা।’
তিনি বলেন, ‘এবারের বন্যায় রোপা আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে নাবি জাতের রোপা ধান যেমন ব্রি-ধান ২২, ব্রি-ধান ২৩ ও ব্রি-ধান ৪৬ চাষের সুযোগ এখনো রয়ে গেছে। এখন ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ অতিবাহিত হচ্ছে। পানি সরে গেলে ভাদ্র মাসের শেষ নাগাদ বিলম্বিত আমনের চারা রোপণ করা যাবে। তা ছাড়া বন্যার পানির স্থায়িত্ব দুই সপ্তাহের কম হলে এর আগে রোপণ করা জলমগ্নতাসহনশীল ব্রি-ধান ৫১, ব্রি-ধান ৫২, ব্রি-ধান ৭৯, বিনা-ধান ১১ ও বিনা-ধান ১২ জমিতে টিকে থাকবে।’
ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শাক-সবজির যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে নিতে হবে আগাম রবি ফসল আবাদের মাধ্যমে। পানি সরে গেলে দ্রুত স্বল্প জীবনকালীন শাক-সবজি যেমন ডাঁটাশাক, পুঁইশাক ইত্যাদি উৎপাদন সম্ভব হবে। তেল ফসল ও ডাল ফসলের মধ্যে মাষকলাই ও সরিষা বিনা চাষেও জমিতে উৎপাদন করা যাবে।
তিনি আরও বলেন, সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফসল হলো সামনের বোরো ধান। মোট চাল উৎপাদনের প্রায় ৫৪ শতাংশই আসে বোরো ধান থেকে। এর জন্যও এখন থেকেই উৎপাদন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো রাসায়নিক সারের সীমিত সরবরাহ। বর্তমানে সারের যে মজুত আছে, তাতে বড়জোর আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে। রবি ফসল ও বোরো ধান আবাদের জন্য অন্তত পক্ষে আরও ৪০-৪৫ লাখ টন সার সংগ্রহ করতে হবে। এর জন্য আমদানির এলসি খোলা সহজতর করতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে স্থাপিত পাঁচটি সার কারখানার কাজ চালু করতে হবে পুরোদমে।
তিনি বলেন, ‘গত দুই বছরে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক সারের দাম দুবার বাড়ানো হয়েছে। কারণ ছিল আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্যবৃদ্ধি। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম হ্রাস পেয়েছে। তাই অভ্যন্তরীণ বাজারেও সারের দাম হ্রাস করা প্রয়োজন।’
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় যে সব জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলোর ক্ষয়-ক্ষতি প্রায় একই রকম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি জেলার কৃষি খাতের ক্ষতির চিত্র নিচে তুলে ধরা হলোÑ
কুমিল্লায় ক্ষতি ৮০০ কোটি টাকা : এবারের ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে কুমিল্লার ১৪ উপজেলা। এসব জেলায় রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, মাছ ও পোল্ট্র্রির পাশাপাশি সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে কৃষিতে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রমতে, রোপা আমনের বীজতলা, রোপা আমন, শাক-সবজি, রোপা আউশ ও আখের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। কুমিল্লা জেলায় আবাদ করা জমির পরিমাণ এক লাখ ৩৫ হাজার ২৩৮ হেক্টর। যার মধ্যে ৬৩ হাজার ৯৭৪ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুমিল্লার উপ-পরিচালক আইউব মাহমুদ বলেন, এবারের বন্যায় কুমিল্লায় কৃষকরা প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি প্রণোদনা, বিনামূল্যে সার ও বীজ বিতরণ, ক্ষুদ্র ঋণ নেওয়ায় সহায়তা, বিনামূল্যে কৃষি সেবা ও সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।
নোয়াখালীতে ক্ষতি ৬৪৩ কোটি টাকা : নোয়াখালীর ৯ উপজেলার মধ্যে আট উপজেলায় ভয়াবহ বন্যায় কৃষি খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬৪৩ কোটি টাকা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, বন্যায় জেলায় মোট ৩৮ হাজার ৪৫৬ হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে রোপা আমন ২৫ হাজার ৬০১ হেক্টর, বীজতলা চার হাজার ৫৩৬ হেক্টর, আউশ চার হাজার ৫২১ হেক্টর, শরৎকালীন সবজি তিন হাজার ২১৬ হেক্টর, ফল বাগান ৪৩৭ হেক্টর, পানের বরজ ৫৭ হেক্টর, আখ ১৩ হেক্টর, আদা ২০ হেক্টর ও হলুদ ৫৫ হেক্টর ক্ষতি হয়েছে। টাকার অঙ্কে এ ক্ষতির হিসাব করা কঠিন। তার পরও প্রাথমিকভাবে বন্যায় নোয়াখালীতে কৃষি খাতে প্রায় ৬৪৩ কোটি টাকা ক্ষতির নিরূপণ করা হয়েছে।
ফেনীর কৃষিতে ৪৫১ কোটি টাকার ক্ষতি : ফেনীতে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ক্ষতচিহ্ন। খেতে মাচান থাকলেও নেই সবুজ গাছ। পানির নিচ থেকে জেগে উঠছে হলুদ, আদা, আউশ, আমন ও শরৎকালীন বিভিন্ন সবজি খেত। দেড় মাসের ব্যবধানে তৃতীয় দফায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার ছয়টি উপজেলায় শুধু কৃষিতেই ক্ষতি হয়েছে ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এতে প্রায় দুই লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তার মধ্যে ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর আমন, ১ হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ, আবাদকৃত ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজির পুরো অংশ, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বন্যায় কৃষিতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। জেলা কার্যালয়ও বুক পানিতে নিমজ্জিত ছিল। তার পরও মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং তাদের নানা পরামর্শের মাধ্যমে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আগাম জাতের কিছু ফসল আবাদের বিষয়ে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুরে ২২৭ কোটি টাকার ক্ষতি : লক্ষ্মীপুরে চলমান বন্যায় কৃষি খাতে ২২৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এক লাখ ৫৭ হাজার ২০৯ কৃষক। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আউশ ধান, আমনের বীজতলা, রোপা আমন ও সবজি ক্ষেতের। এ ছাড়া পান, আখ, হলুদ, আদা এবং নানা জাতের ফলের গাছেরও ক্ষতি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্রুত কৃষকদের মধ্যে যাতে পুনর্বাসন প্রণোদনা দেওয়া যায়, কর্তৃপক্ষ সে নির্দেশনা দিয়েছে। এরই মধ্যে আমরা ৬ হাজার কৃষকের মধ্যে আমন ধানের বীজ ও সার বিতরণ করা হয়েছে। তাদের অ্যাকাউন্টে এক হাজার টাকা করে সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আগাম রবি মৌসুমের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ হাতে পাওয়া গেছে। এর আওতায় ১৩২০০ কৃষকের মধ্যে গম, ভুট্টা, সরিষা, সূর্যমুখী, মুগ, মসুর, খেসারি, চিনা বাদাম, সয়াবিন, শীতকালীন পেঁয়াজ বীজ বিতরণের জন্য কর্মসূচি আসবে। তা ছাড়া, ৬৫ হাজার কৃষকের জন্য প্রণোদনা হিসেবে শীতকালীন সবজির চাহিদা পাঠানো হয়েছে ওপর মহলে। যাতে বাড়ির আঙ্গিনায় শীতের সবজি চাষ করা যায়, সে জন্য সহযোগিতা করা হবে।
মৌলভীবাজারে ক্ষতি ২০৫ কোটি টাকা : সাম্প্রতিক বন্যায় মৌলভীবাজারে আউশ ও আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেসে গেছে আউশ ধান এবং বোরোর বীজতলা। ধানের পাশাপাশি নষ্ট হয়ে গেছে নানা মৌসুমি ফসল। এ সমস্ত কিছুর পরিমাণ নির্ধারণ করেছে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাদের হিসাবে মৌলভীবাজারের ৭ উপজেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় কৃষিতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০৫ কোটি টাকা।
জেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, আউশ আবাদের মৌসুম শেষ হয়েছে আগেই। আর কয়েকটা দিন সময় পেলে আউশ ধান ঘরে তুলতে পারতেন কৃষক। আমনের চারা রোপণের সময়ও শেষ পর্যায়ে। পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু কৃষক নতুন করে আমন ধানের বীজতলা তৈরি করছেন। কেউ কেউ আবার হালিচারা সংগ্রহ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে অনেকের পক্ষেই চলতি মৌসুমে নতুন করে চাষাবাদ সম্ভব হবে না। সব মিলিয়ে এবার আউশ ও আমন ধানের উৎপাদন কমতে পারে।
এই অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে সরকার। বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি বিভাগ থেকে জেলার ৪ হাজার কৃষকের প্রত্যেককে পাঁচ কেজি করে বিনামূল্যে স্বল্পমেয়াদি ব্রি-৭৫, বিনা-১৭ জাতের বীজধান, প্রত্যেককে ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার এবং ১ হাজার টাকা বিতরণ করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামে ক্ষতি ৩৯৪ কোটি টাকা : ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামে কৃষি খাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলা ও নগরীর আংশিক এলাকায় প্রায় ৩৯৪ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র নিরূপণ করেছে। বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এলাকার ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন। বন্যায় চট্টগ্রাম কৃষি অঞ্চলে ১ লাখ ৫৩ হাজার ১০৩ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই, ফটিকছড়ি, সীতাকু-, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও চন্দনাইশ উপজেলায় ফসলের বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ সাত উপজেলায় বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ১ হাজার ৯২২ হেক্টর সবজি বাগান। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ ও আমন খেত। আমন ধানের উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রায় অর্জিত না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রামে শুধু আমনের ক্ষতি হয়েছে ২৫২ কোটি টাকার মতো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা জানান, এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলা ও নগরীর আংশিক এলাকা মিলে আনুমানিক ৩৯৪ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কৃষি খাতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হচ্ছে। শীঘ্রই ক্ষয়ক্ষতির সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ণয় করা হবে।
সূত্র: দৈনিক জনকন্ঠ