সংগৃহীত
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তবে এর নির্মোহ এবং পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ কতখানি করা হয়েছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এমন একটা সময় আমরা পার করেছি, যখন সরকার কিংবা তার গৃহীত নীতি বা পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা করা দুরূহ ছিল। এর পরও শিক্ষাক্রমটি চালু হওয়ার পরপর আমরা এর, বিশেষত গণিত ও ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনার প্রয়াসে দুটি আলোচনা করেছি– মাধ্যমিকে ডিজিটাল প্রযুক্তি শিক্ষা: আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা (সমকাল, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩) এবং নতুন পাঠ্যক্রমের গণিত বই: অল্প অর্জন, বিশাল আশঙ্কা (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকম, ২১ মার্চ ২০২৩)। আজকের আলোচনার প্রেক্ষিত অবশ্য ভিন্ন। এর মধ্যে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেছে।
অনেক রক্তের বিনিময়ে ছাত্র-জনতার যৌথ প্রয়াসে বাংলাদেশ এখন সর্বক্ষেত্রে অর্থবহ সংস্কারের স্বপ্ন দেখছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্মানীয় শিক্ষা উপদেষ্টা খুব স্পষ্ট করে নতুন শিক্ষাক্রমের অসারতা নিয়ে মন্তব্য করেছেন এবং ভাববার প্রয়াস নিয়েছেন, কীভাবে শিক্ষার্থীদের সর্বনিম্ন ‘অস্বস্তি’ নিশ্চিত করে পুরোনো শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া যায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের এই আলোচনা।
প্রথম একটা বড় অস্বস্তির বিষয় হলো, বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিভাগ তুলে দেওয়া এবং উচ্চতর/ঐচ্ছিক গণিত বাদ দেওয়া, যা উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বড় ধরনের সমস্যা করতে পারে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যারা ভৌত কিংবা ফলিত বিজ্ঞান অথবা প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করতে চান, তারা সেই পড়াশোনার জন্য যথাযথ/পর্যাপ্ত
মৌলিক ধারণা পেয়ে আসবেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তবে সম্প্রতি সরকার মাধ্যমিকে আবার বিভাগ বিভাজনের ঘোষণা দিয়েছে এবং নিঃসন্দেহে উচ্চতর/ঐচ্ছিক গণিত ফিরবে।
দ্বিতীয়ত, মূল্যায়ন পদ্ধতি। যে প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে ষাণ্মাসিক পরীক্ষা হচ্ছিল, আগের দিন বিদ্যালয়ে পাঠানো প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছিল, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। যা হোক, এ মূল্যায়ন পদ্ধতিও বাদ দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই শিক্ষাক্রমে ব্যক্তিগত মূল্যায়নের ওপর তেমন গুরুত্ব দেখিনি, যেটা দেওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। দলগত মূল্যায়নের ধারণাকেও আমরা স্বাগত জানাই, কিন্তু ব্যক্তিগত মূল্যায়নকে দুর্বল করে নয়।
আমাদের সংস্কৃতি ও শিক্ষা ব্যবস্থায় মুখস্থ-নির্ভরতা এবং পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা; দুটোই বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত। ঠিক আগের শিক্ষাক্রমে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রচলনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী প্রাক-সৃজনশীল পর্বের মুখস্থ-নির্ভরতা কমানোর একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি! এর একটি মূল কারণ হলো মানসম্মত প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দুর্বলতা। মাউশির জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ৪২ শতাংশ (দৈনিক যুগান্তর, ১৯ নভেম্বর ২০২২) শিক্ষক ন্যূনতম মানসম্পন্ন প্রশ্ন করতে অক্ষম। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি সফল করতে হলে অস্ট্রেলিয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণপূর্বক আলাদা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমে প্রশ্ন করে প্রশ্নব্যাংকের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ ধরনের একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প চালু করেছিল যশোর শিক্ষা বোর্ড। সে অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। কিছু বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির কাঠামো বা আঙ্গিকের শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী পরীক্ষাগুলোতে যেমনটা হয়ে থাকে, তেমনটা অর্থাৎ বইয়ের বাইরের কিছু সমস্যা দেওয়া যেতে পারে। রচনামূলক বিষয়গুলোতে ৩-৪ পৃষ্ঠা মুখস্থ লেখার প্রয়োজন যেন না হয়; তথ্য মনে রাখার চেয়ে তার অনুধাবন ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা যাচাই যেন মুখ্য হয়; সেদিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। বস্তুত আমরা যা এখানে বলছি তা একদম নতুন কিছু, তা কিন্তু নয়। বরং অন্য দেশের বা আমাদের দেশে প্রচলিত ইংরেজি মাধ্যমে প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যাবে ভালো মূল্যায়ন পদ্ধতির।
তৃতীয় বিষয়টি হলো, বইয়ের মান। প্রতি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের এ নিয়ে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আমরা ইতোমধ্যে গণিত ও ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করেছি পূর্বোক্ত লেখা দুটোতে। গণিত বইয়ের অনুশীলনীতে প্রদত্ত সমস্যার সংখ্যা বিগত বইয়ের তুলনায় ১০ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে– ভাবা যায়! ব্যক্তিগত অনুশীলনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের যে দক্ষতা তৈরি হয়, তার সুযোগ এখন অত্যন্ত সীমিত। এর ফলে অবধারিতভাবে শ্রেণিশিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজনীয়তা এবং গাইড-নির্ভরতা বাড়বে। ডিজিটাল প্রযুক্তি বই বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রূপরেখায় বিবৃত প্রধান যোগ্যতা যেমন সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন, কম্পিউটেশনাল চিন্তন, ডিজাইন চিন্তন সম্পর্কিত কনটেন্ট মাত্র ১০ শতাংশ (সেটাও অত্যন্ত দুর্বল), বাকিটা ‘শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করা’ শেখানোর জন্য। অর্থাৎ লক্ষ্যের ক্ষেত্রে যত উচ্চাভিলাষ, তার সঙ্গে কনটেন্টের সাযুজ্য নেই।
এ ছাড়া বইয়ের মানসংক্রান্ত দুটো বড় দুর্বলতা আমাদের চোখে পড়েছে, যা হয়তো সব বিষয়ের জন্যই প্রযোজ্য। প্রথমত, বই রচনার সঙ্গে যারা জড়িত (অর্থাৎ লেখক, সম্পাদক ইত্যাদি) তাদের নির্বাচনের সময় যথাযথ মানদণ্ড বা নির্ণায়ক অনুসরণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কিনা। সত্যি কথা বলতে, বিগত সময়গুলোতে নির্ণায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সরকারের প্রতি আনুগত্য। এ প্রসঙ্গে বর্তমান কারিকুলামের বাংলা বইয়ের অন্যতম লেখক অধ্যাপক তারিক মনজুর (৭ মে, ২০২৩) প্রথম আলোতে লিখেছেন ‘বইয়ের লেখক হিসেবে যাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদেরও দলীয় পরিচয় ছাড়া আর কোনো খোঁজ নেওয়া হয় না। আর অনেক ক্ষেত্রে সম্পাদকরা শুধু নামেই সম্পাদক থাকেন– প্রকাশের আগে অনেকে বইয়ের কপিও দেখেন না।’ এ কারণেই হয়তো সবচেয়ে যোগ্য বিশেষজ্ঞদের আমরা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য পাচ্ছি না।
সবশেষে যে বিষয় নিয়ে আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে চাই, সেটি হলো, আমাদের দেশে স্কুল পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষকের অভাব দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এই সমস্যা আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব, সেটা এক বড় প্রশ্ন। এ প্রসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য ফিনল্যান্ডের উদাহরণ টানা যেতে পারে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষকরা কীভাবে পড়াবেন, সে ব্যাপারে অনেক স্বাধীনতা উপভোগ করেন এবং এটি তাদের অনেক বেশি সৃজনশীল হতে সাহায্য করেছে। তবে এই সৃজনশীলতা অর্জন প্রক্রিয়া মোটেই সহজ নয়। ফিনল্যান্ডে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য একজনকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদানে পাঁচ বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে হয়! এ প্রসঙ্গে হেলসিঙ্কি ইউনিভার্সিটির শিক্ষকতা বিষয়ের অধ্যাপক লীনা ক্রোকফর্সের মন্তব্য বিশেষভাবে স্মর্তব্য [বাংলা ভাবানুবাদ] ‘...শিক্ষকদের এই উচ্চমানের শিক্ষা থাকা দরকার, যাতে তারা অনুধাবন করতে পারেন যে কীভাবে তাদের দেওয়া স্বাধীনতা ব্যবহার করতে হবে এবং শিখতে পারেন কীভাবে গবেষণাভিত্তিক উপায়ে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি আমরা তাদের শেখাই তা হলো, পাঠদান প্রক্রিয়ার বিষয়ে যাতে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং তার সফলতা/বিফলতার বিচার নিজেরাই করতে পারেন।’
স্পষ্টতই ফিনল্যান্ড তাদের শিক্ষকদের স্বাধীনতা দেওয়ার পাশাপাশি তারা যাতে বিচার-বিশ্লেষণপূর্বক সঠিক পদ্ধতিটি বেছে নিতে পারেন সেই সক্ষমতাও তৈরি করেছিল। আমাদেরও এই আঙ্গিকে ভাবতে হবে, পরিকল্পনা নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি। তবে রাতারাতি তো সম্ভব নয়। তাহলে অন্য কী সমাধান থাকতে পারে? মানসম্মত শিক্ষক নিশ্চিত না করা পর্যন্ত মানসম্মত বইয়ের পাশাপাশি ইলেকট্রনিক রিসোর্সের ব্যবহারকে মূল বইয়ের সহযোগী হিসেবে পরিকল্পনা করা, যা বিভিন্ন দেশে প্রচলিত। খান একাডেমির মতো প্ল্যাটফর্ম সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়। আমাদের দেশে বাংলায় এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম তৈরি ও তাতে মানসম্পন্ন কনটেন্ট নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ভালো স্কুল/কলেজের শিক্ষকদের নিয়ে লেকচার ভিডিও করে সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়া যায়। তবে তাদের যদি ভালো স্লাইড বা অন্য উপকরণ তৈরিতে গ্রাফিক্স ডিজাইনার ও আনুষঙ্গিক সহায়তা দেওয়া যায়, তবে এগুলোর কার্যকারিতা আরও বাড়বে। কিছু উন্নয়ন সহযোগীর অর্থায়নে এমন অনেক ইলেকট্রনিক কনটেন্ট ও সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন তৈরির কথা শোনা যায়। কিন্তু সফল কোনো ব্যবহারের উদাহরণ আমাদের চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে একটি সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
লক্ষ্য রাখতে হবে, সার্বিকভাবে শিক্ষাকে যেন যতটা সম্ভব আনন্দময় করা যায়। এ ক্ষেত্রে বর্তমান শিক্ষাক্রমের কিছু বিষয় অনুসরণীয় হতে পারে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখা একটি ভালো উদ্যোগ। অহেতুক মুখস্থনির্ভর ব্যাকরণ কমিয়ে আনা হয়েছিল। ইংরেজি বইয়ের গুণগত মান ও অ্যাপ্রোচ উন্নত হয়েছে। বিজ্ঞান বইয়ের গদ্যভাষা প্রাঞ্জল। ইতিহাস, সামাজিক বিজ্ঞানসহ অন্যান্য কিছু বিষয় যেন আরও সাবলীল গদ্যশৈলীতে লেখা হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। নির্মোহভাবে বর্তমান শিক্ষাক্রম, পাঠ্যবই ও তার সমাদৃত-নিন্দিত বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করে দ্রুতই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী সহজ যোগাযোগের এ যুগে অন্যান্য দেশের শিক্ষা-চর্চার গ্রহণযোগ্য দিকগুলো অনুসরণ করে, উঁচু মানের বই ও সম্পূরক ইলেকট্রনিক রিসোর্স তৈরি করে শিক্ষার্থীদের শিক্ষক-স্বল্পতার প্রভাব থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে হবে।
ড. অনিন্দ্য ইকবাল: অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, বুয়েট ও ড. মো. সোহেল রহমান: অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, বুয়েট এবং ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি
সূত্র: সমকাল