শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

হাইব্রিড মরিচ চাষে ঝুঁকছেন বগুড়ার কৃষকেরা

হাইব্রিড মরিচ চাষে ঝুঁকছেন বগুড়ার কৃষকেরা

সংগৃহীত

যমুনা নদী বেষ্টিত বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার চরাঞ্চলে প্রতি বছরই বাড়ছে মরিচের আবাদ।  তবে এ অঞ্চলে কমে যাচ্ছে দেশি জাতের কাঁচা ও লাল মরিচের আবাদ। সেই স্থান দখল করছে এখন উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রিড) নানা জাতের মরিচ।

শুক্রবার জেলার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মরিচ চাষিদের সঙ্গে কথা হলে এ তথ্য উঠে আসে।

জানা যায়, চাষাবাদ এবং ফলন বেশি হওয়ায় এবার মরিচের দাম গত বছরের তুলনায় কম। এরপরেও মরিচ চাষে লাভবান কৃষক। বগুড়ায় উৎপাদিত মরিচের বেশি অংশ শুকানোর পর চলে যায় দেশের বিভিন্ন মসলা প্রস্তুতকারি কোম্পানিতে। এ জেলার মরিচের রং এবং ঝাল বেশি হওয়ায় এর চাহিদাও বেশি। যার কারণে কোম্পানিগুলো মরিচ কেনার জন্য প্রতিনিধির মাধ্যমে মৌসুমের শুরু থেকেই তৎপরতা চালাতে থাকে।

কৃষকেরা জানান, প্রতি বছর যমুনার পানি নেমে যাওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকেন চরাঞ্চলের মরিচ চাষিরা। যমুনার বুক খালি হলেই কপাল খুলে যায় নদী ভাঙনের শিকার মানুষগুলোর। পানি নেমে যাওয়া মাত্র চরের উর্বর মাটিতে পা ফেলেন তারা। তোড়জোড় শুরু করেন মরিচ চাষে। প্রতিবছরই মরিচ ফলানোর কাজটি করেন চরাঞ্চলের চাষিরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবার রবি মৌসুমে ১২টি উপজেলায় সাড়ে সাত হাজার হেক্টর জমিতে মরিচ চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও চাষাবাদ হয়েছে পাঁচ হাজার ৭১৮ হেক্টর। এরমধ্যে সিংহভাগ মরিচ চাষ হয় সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায়। শুধুমাত্র সারিয়াকান্দিতেই তিন হাজার ৩১০ হেক্টর জমিতে মরিচ চাষ করেছেন কৃষকেরা। এরমধ্যে হাইব্রিড জাতের মরিচের চাষ হয়েছে দুই হাজার ১৫০ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের এক হাজার ১৬০ হেক্টর জমিতে।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মরিচ আবাদ হয়েছে যমুনা তীরবর্তী আরেক উপজেলা সোনাতলায়। এছাড়া ধুনট ও গাবতলী উপজেলায় ব্যাপক মরিচের আবাদ হয়েছে। গত বছর সারিয়াকান্দিতে হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষ করা হয়েছিল এক হাজার ৪৫০ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের মরিচ দুই হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ জমিতে হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষ করার ফলে স্থানীয় জাতের মরিচের স্থান এখন হাইব্রিডের দখলে।

সারিয়াকান্দি উপজেলার কৃষক সোবাহান মোল্লা বাংলানিউজকে জানান, এ বছর অনেক কৃষক হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষ করেছেন। টানা তিন থেকে চার মাস চরাঞ্চলের চাষিরা মরিচ চাষে ব্যস্ত সময় পার করবেন। উর্বর মাটির কারণে চরের জমিতে মরিচ ভালো হয়। আর চরের মরিচ গুণে মানে স্বাদেও অতুলনীয়। সারাদেশে চরের মরিচের চাহিদা রয়েছে বেশি।

তিনি আরও জানান, গত বছরের তুলনায় এবার মরিচের দাম কম। এবার রবি মৌসুমে তিনি সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে ‘খ্যাতির মরিচ’ লাগিয়ে ছিলেন। উপযুক্ত হওয়ার পর প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে প্রায় তিন মাস একটানা মরিচ উঠানো হয়। মরিচ চাষাবাদে বেশি ব্যয় পড়ে শ্রমিক ও কীটনাশকে। মরিচ গাছগুলো ঠিক রাখতে প্রায়ই প্রতিদিনই নিয়মানুযায়ী ওষুধ দিতে হয়।

ধুনট ও সোনাতলা উপজেলার কৃষক আবেদ আলী, জসিম মিয়া জানান, প্রতি বিঘা মচির চাষে ব্যয় হয়েছে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। চরের উৎপাদিত মরিচ বিক্রি নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয় না তাদের। দেশের নামিদামি অনেক কোম্পানি বা বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখানকার মরিচ ক্রয় করে নেয়। ক্ষেতের মরিচ উঠানোর সময় থেকেই কোম্পানির পক্ষ থেকে এসব এলাকায় বিক্রয় প্রতিনিধি আসতে থাকে।

তারা আরও জানান, গত বছর চরের শুকনো মরিচ প্রতি মণ ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকা করে বিক্রি হয়েছে। এ বছর সেই মরিচ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। এ কাজে বাড়ির নারীরাও সমানভাবে সংযুক্ত থাকেন। মরিচ লাগানো, উঠানো, শুকানো ও বস্তায় ভরা পর্যন্ত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পুরুষকে সহযোগিতা করেন নারীরা। চাষাবাদের সময় বাড়তি আয়ের আশায় সবাই একযোগে মরিচের ক্ষেতে ব্যস্ত থাকেন বলেও মন্তব্য করেন তারা।

মরিচ ব্যবসায়ী হাসানুল ইসলাম জানান, এবার তিনি মৌসুমের শুরুতেই দুই হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে লাল মরিচ কিনছেন। গত বছর এই সময়ে মরিচ কিনেছিলেন তিন হাজার ৫০০ টাকা মণ দরে। এক মণ লাল মরিচ শুকিয়ে ৮ থেকে ১০ কেজি শুকনা মরিচ পাওয়া যায়। গত বছর তিনি ১৫০ টন শুকনা মরিচ ঢাকার বিভিন্ন মসলা প্রস্তুত কোম্পানিতে সরবরাহ করেছেন। এবার মরিচের দাম কম থাকায় টার্গেট নিয়েছেন আরও বেশি শুকনা মরিচ সরবরাহ করার।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী পরিচালক মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, বগুড়ায় এবার দেশি জাতের মরিচ আবাদ হয়েছে দুই হাজার ৫৫ হেক্টর এবং হাইব্রিড জাতের আবাদ হয়েছে তিন হাজার ৬৬৩ হেক্টর জমিতে। জেলার মোট মরিচ আবাদের প্রায় ৭০ শতাংশই হয়েছে সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনার চরাঞ্চলে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে কৃষকদের উৎপাদন বাড়াতে হচ্ছে। উৎপাদন বাড়লে কৃষকের লাভও বেশি হয়। এ কারণে তারা স্থানীয় জাতের পরিবর্তে হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষের দিকে ঝুঁকছেন।

বগুড়ার চরাঞ্চলের মরিচ গুণগত মান অনেক ভালো। চরের মরিচের ফ্লেভার বেশ আকর্ষণীয়। সেই সঙ্গে স্বাদেও অতুলনীয়। এসব সুবিধা বিবেচনা করে চরের মরিচের প্রতি; দেশের নামকরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের আলাদা আগ্রহ রয়েছে। এতে করে চরে উৎপাদিত মরিচের দাম তুলনামূলক বেশি পাওয়া যায়।

সর্বশেষ: